নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজশাহী নগরীর উপকণ্ঠ শাহাপুর পশ্চিম পাড়া। পদ্মা নদীর কোল ঘেষে সবুজে ঘেরা ছোট্ট একটি গ্রাম। নদীর তীরে বসে ষাট উর্ধ্ব এক ব্যক্তি নৌকা বানাচ্ছেন। নৌকাটি বানাতে তিনি বেশ ব্যস্ততার মধ্যে রয়েছেন। সকাল গড়িয়ে সূর্য অস্তমিত প্রায়। কাজের তোড়ে তার সেদিকে কোন নজরই নেই।
হাবিবুর রহমান পেশায় একজন নৌকার কারিগর। তার বাড়ি বাঘা উপজেলার চকেনাইত গ্রামে। এই গ্রামে তিনি এসেছেন মাজদার জেলের নৌকা বানাতে। মাজদারের সাথে চুক্তি হয়েছে ৭ দিনের মধ্যে তিনি ২০ ফিটের এই নৌকা তৈরি করে দিবেন। বিনিময়ে নিবেন ১২ হাজার টাকা। নদীতে এখন যেমন স্রোত তেমন পানি। এই নদীতে বড় বড় মাছ পাওয়া যায়। নৌকা তৈরি হয়ে গেলেই মাজদার মিয়া সেই নৌকা নিয়ে নামবেন নদীর বুকে জাল বিছাতে।
নৌকার কারিগর হাবিবুর রহমান জানান, মাত্র ১৫ বছর বয়সে শখের বসে নৌকা বানানো শুরু করেন। শুরুর সময়টাতে তার নৌকা বানানোর ওস্তাদ ছিলেন রুস্তম আলি। কিশোর বয়সের সেই শখ এখন তার পেশায় পরিণত হয়েছে। তিনি এখন সবার কাছে নৌকার কারিগর হিসেবেই পরিচিত। হাবিবুর রহমান বয়স এখন ৬৫। তিনি প্রায় ৫০ বছর ধরে নৌকাই বানিয়ে চলেছেন। এখন বছরে ৪ থেকে ৫ মাস নৌকা বানান। এসময়ের মধ্যে তিনি ৪ থেকে ৫টি নতুন নৌকা বানান, আর সংস্কারের কাজ করেন ১৫ থেকে ২০টির মতো। তবে একটা সময় যখন তিনি একাই প্রতি বছর অন্তত ২০ থেকে ২৫ টি নৌকা বানাতেন। কাজের চাপে তাও আবার কাউকে কাউকে ফিরিয়ে দিতে হতো। হাবিবুর রহমানের দাবি, নৌকার কারিগরদের সেই দিন ফুরিয়েছে। তার গ্রামে এক সময় ৫০ টি মতো নৌকার কারিগর ছিলেন। এখন কেউ মারা গেছেন, বেউ বা বৃদ্ধ হয়েছেন। নতুন করে এই পেশায় আর কেউ আসছে না। সেই সুযোগে লোহা বা টিনের তৈরি নৌকার চাল চাহিদা বড়ছে।
রাজশাহীর পদ্মা তীরবর্তী বাঘা, চারঘাট, পবা, গোদাগাড়ী, বাগমারা সহ পদ্মার বুকে পুরাতন চরিটি চরে এখনও নৌকার কদর রয়েছে। এসম উপজেলার পদ্মা নদী তীরবর্তী গ্রামের মানুষেরা অন্যান্য কাজের চাইতে পদ্মা থেকে মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতেই বেশি স্বাচ্ছন্ন বোধ করেন। নদী থেকে মাছ ধরে সেই নদী তীরেই সকালে বা বিকেলে হাট বসিয়ে তা বিক্রি করেন ফরিয়া বা আড়তদারদের কাছে। এক থেকে দুই ঘন্টার মধ্যেই সেই মাছ বিক্রি শেষ হয়ে যায়।
নৌকা কারিগর হবার কারণ হিসেবে হাবিবুর রহমান বলেন, সেসময় বিশাল পদ্মা। আপনারা পদ্মার সেই রূপ দেখেন নাই। বর্ষা মৌসুমে ভরা পদ্মার ডাকে রীতিমতো ভয় পেতো মানুষ। এই পদ্মায় তখন প্রচুর নৌকা চলতো। মাছ ধরা ও পণ্য আনা নেয়ার পাশাপাশি গ্রামে রাস্তা-ঘাট না থাকা বা দুরাবস্থার কারণে সেসময় মানুষ নৌকাতেই যাতায়াত করতো। আর তাই নৌকার কদরও ছিল বেশি। সেই চাহিদার কথা মাথায় নিয়েই এই নৌকা বানানো শেখা। আর এখন নৌকার কদর কমলেও অন্য কোন কাজ না জানায় এই কাজ ধরেই বসে থাকতে হয়েছে।
এদিকে নৌকা তৈরিতে ব্যয় বেড়েছে। ২০ থেকে ২৫ ফিট আয়তনের একটা নৌকা তৈরি করতে এখন খরচ হয় ৩০ হাজার টাকা। আর ৫০ ফিটের একটা নৌকা তৈরি করতে খরচ হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। ৩০ ফিটের একটা নৌকা তৈরি করতে ১২ থেকে ২০ দিন সময় লাগে। একটি নৌকার সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ অংশ সোল বা পানি বাতাস। এই অংশটি বানানোটাও বেশ কঠিন কাজ।
হাবিবুর রহমানের পাশেই নদী তীরে একটি নৌকায় আলকাতরা লাগাচ্ছেন মধ্য বয়সী এক ব্যক্তি। জামাল পেশায় জেলে। নৌকাটি তার নিজের। কারিগরের খচর বেশি হওয়ায় তিনি নিজেই নৌকার ছোটখাট কাজগুলো মেরামত করে থাকেন। নৌকার গায়ে আলকাতরা লাগানো ফাকে তিনি বলেন, নদীতে সেভাবে আর মাছ নাই। বড় বড় শিকারিরা ফোল্ডিং চায়না জাল ফেলে ছোট বড় সব মাছ ধরে নিচ্ছে। ওদের কাছে আমাদের মতো জাল ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরা জেলেরা পাত্তা পায় না। এখন টাকা আছে যার নদী আর নদীর মাছ তার।